ইদানিং ফেইসবুক খুললেই একটি ধূমকেতুর ছবি দেখছি। ধূমকেতুটি এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ আগে দেখা যাচ্ছে। এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন ধূমকেতু। নাসার স্পেস টেলিস্কোপ Near Earth Object Widefield Infrared Survey Explorer (NEOWISE) এর সাহায্যে এটি আবিষ্কৃত হয়েছে, এজন্য ধূমকেতুটির নামও দেওয়া হয়েছে, “NEOWISE”। তবে টেকনিক্যালি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একে C/2020 F3 (NEOWISE) নামে ক্যাটালগ ভুক্ত করেছেন। এটি আবিষ্কৃত হয়েছে এ বছরের ২৭ মার্চ। সূর্য থেকে এই ধূমকেতুর এপিহেলিওন হলো ১১২.৭৯৬৭৯৪৫ ট্রিলিয়ন মিটার আর পেরিহেলিওন হয়েছে ৩ই জুলাই, ২০২০। অনেকের মনে পশ্ন জাগতে পারে পেরিহেলিওন আর এপিহেলিওন কি। চলুন জেনে আসি এবার একটু এই বিষয়ে।
এপিহেলিওন এবং পেরিহেলিওন কী?
এপিহেলিওন হলো পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে সূর্যের সর্বোচ্চ দূরত্ব আর পেরিহেলিওন হলো পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে সূর্যের সবচেয়ে নিকটতম দূরত্ব।
ধূমকেতু কী?
ধূমকেতু হলো বরফ, ধূলিকণা ও ঘনীভূত গ্যাসের তৈরি এক ধরনের মহাজাগতিক বস্তু। এরা সাইজে খুব বড় নয়। প্রস্থে কয়েক শ মিটার থেকে দশ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এই ধূমকেতু গুলো উপবৃত্তাকার পথে সূর্যের চারদিকে আবর্তন করে। এদের আবর্তন কাল কয়েক বছর থেকে শুরু করে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত হতে পারে। তবে মজার একটি তথ্য হলো নতুন এই ধূমকেতুটির আবর্তনকাল ৬৭৬৬ বছর। এছাড়াও এবছরের ১৫ই জুন NASA Citizen Science Project এর Citizen Scientist দের দ্বারা নতুন ৪০০০ কমেট আবিষ্কৃত হয়েছে।
ধূমকেতুটিকে কখন এবং কীভাবে দেখা যায়?
বাংলাদেশে যারা এখনো Comet C/2020 F3 NEOWISE কে দেখতে পারেন নি তাদের জন্য এই পোস্ট। ☄️ এই বছরে কমেট ATLAS এবং SWAN-এর পর এটি তৃতীয় ধুমকেতু যা মানবজাতি নিজ চোখে দেখার সুযোগ পাচ্ছে। নাসার NEOWISE স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে ২৭ শে মার্চ এটিকে আবিষ্কার করা হয়। গত সপ্তাহে ধূমকেতুটি সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো। এখন ফিরতি পথে চলে যাচ্ছে সূর্য থেকে দূরে। ধূমকেতুটি এ সপ্তাহে পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করবে এবং সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ আগে খালি চোখে দেখা যাবে। এখন খুব ভোরে সূর্য উঠার আগে একে দেখা যাচ্ছে। Nautical twilight (ভোর ৪ঃ২২-৪ঃ৫২)-এ পূর্বে থাকা উজ্জ্বল Venus থেকে উত্তর-পুর্বে Auriga constellation এর Capella তারাটির নিচে অবস্থিত Menkalinan এর ঠিক নিচেই ধুমকেতুটিকে দেখা যায়। ১১-১২ জুলাই একে দেখতে চাইলে উপরোক্ত নির্দেশনা অনুসরন করলেই যথেষ্ট। ১১ ই জুলাইয়ের মধ্যে, ধূমকেতুটি প্রায় ১০ ডিগ্রি উচ্চতায় পৌঁছে যাবে অর্থাৎ ১০ ডিগ্রি প্রায় হাতের দৈর্ঘ্যে আপনার মুষ্টির প্রস্থের সমান। তারপরে পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে এটি ধীরে ধীরে উত্তর-উত্তর-পূর্ব দিগন্তের দিকে পিছনে সরে যাবে এবং অবশেষে ভোরের দৃশ্যমানতা থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। গত একসপ্তাহ একে ভোরে বা সূর্য উঠার ৩০ থেকে ৮০ মিনিট আগে দেখা গেলেও জুলাইয়ের মাঝামাঝি (১২-১৫ জুলাইয়ের কাছাকাছি), ধূমকেতুটি সন্ধ্যার দিকে (সূর্যাস্তের ঠিক পরে) দেখা যাবে, উত্তর-পশ্চিম দিগন্তের নীচে। জুলাই ১২-১৮ এর মধ্যে আপনি এটিকে সন্ধ্যা ও ভোর উভয় সময়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। ১৫-১৭ জুলাই পর্যন্ত একে সূর্য ডুবার পর প্রায় ১ ঘন্টা পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম দিগন্তে Ursa Major constellation এর ঠিক নিচেই পাওয়া যাবে। ১৮-২৩/২৪ জুলাই পর্যন্ত সন্ধায় এটা ঠিক উওর-পশ্চিম বরাবর Ursa Major constellation এর Talitha ও Tania Australis+ Tania Borealis মধ্যবর্তী স্থানেই দৃশ্যমান থাকবে অর্থাৎ Leo Minor constellation-এর ডানেই দেখা যাবে। ধূমকেতুটি ২২-২৩ জুলাই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে। এটি আমাদের গ্রহ থেকে প্রায় ১০৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে অতিক্রম করে যাবে। ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে এটি ক্রমান্বয়ে আকাশের আরো উপরের অংশে চলে যাবে। পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিগন্ত থেকে প্রায় ৩০ ডিগ্রি উচ্চতায় চলে যাবে। ৩০-৩১ জুলাই ধুমকেতুটি Coma Berenices বা Berenice’s Hair স্টার ক্লাস্টারের ঠিক উত্তরে চলে যাবে।
বাংলাদেশ থেকে কি দেখা সম্ভব?
এই বিষয়ে বাংলাদেশি জ্যোতির্বিদ দীপেন ভট্টাচার্য স্যার কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান,
আমি বলব ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে দেখা চেষ্টা করতে। সূর্যোদয়ের দু ঘন্টা আগে এমন একটা জায়গা বাছতে হবে যেখান থেকে দিগন্তের উত্তর-পূর্ব দিকটা দেখা যায়। ডানদিকে উজ্জ্বল শুক্রগ্রহকে দেখা যাবে, সেটাই হবে সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু আকাশে (চাঁদ ছাড়া)। এরপরে উওর-পূর্বের সোজাসুজি সবচেয়ে উজ্জ্বল তার হবে ক্যাপেলা Capella (বাংলা নাম ব্রহ্মহৃদয়)। ক্যাপেলার নিচে যে একটি অনুজ্জ্বল তারা (বিটা অরিগা) সেটা বের করে ক্যাপেলা ও বিটা অরিগাকে একটা কাল্পনিক রেখা দিয়ে যোগ করে তাদের অন্তর্বর্তী দূরত্বের সমান মাপে ধূমকেতুটি পাওয়া যাবে। একটি বাইনোকুলার (যে কোনো ক্ষমতার) থাকলে ধূমকেতুটি ধরতে সহজ হবে। ১৪ তারিখের পরে এটিকে সন্ধ্যায় দেখা যাবে উত্তর পশ্চিমে (আমার পোস্টে একটি মানচিত্র আছে), কিন্তু মনে হয় ধূমকেতুটি তখন ম্লান হয়ে আসবে।
দীপেন ভট্টাচার্য স্যার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইড-এ জ্যোতির্বিদ্যায় গবেষণা করছেন। এছাড়া অধ্যাপনা করছেন রিভারসাইড কমিউনিটি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়ায়। প্রাক্তন গবেষক, NASA Goddard Space Flight Center, ম্যারিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।
ধূমকেতু নিওউয়াইজ এখন ক্যাপেলা তারার নিকটে আছে, আপাত ঔজ্জ্বল্য = ১ । এটা এখন ভোররাতের দিকে দেখা যাচ্ছে তবে ক্রমশঃ আরো আগে থেকে দেখা যাবে এবং আরো উজ্জ্বল হবে । ধূমকেতুটি ২২-২৩ জুলাই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে। এটি আমাদের গ্রহ থেকে প্রায় ১০৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে অতিক্রম করে যাবে। ২৩ জুলাই ধূমকেতুটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসবে এবং সৌভাগ্যক্রমে চাঁদ থাকবে ওয়াক্সিং ক্রিসেন্টে কারণ ২০ জুলাই আমাবস্যা। তখন মধ্যরাতের আগ থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যাওয়ার কথা।
আমরা BARC থেকে চেষ্টা করছি বাংলাদেশ থেকে কোথায় কোথায় দেখা সম্ভব তার একটি তালিকা তৈরী করার। আকাশ মেঘমুক্ত পরিষ্কার হলে খালি চোখেই একে দেখা সম্ভব। ঢাকা থেকে কোনোভাবেই হয়তো এই ধূমকেতুটিকে দেখা সম্ভব নয় প্রচুর আলোকদূষণের কারণে। একটি মোটামুটি মানের বাইনোকুলার ও টেলিস্কোপের সাহায্যে এর লেজটা ভালোভাবে ই দেখা সম্ভব। আর যদি হাই স্পেসিফিকেশনের টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন তাহলে নিঃসন্দেহে অসাধারন একটা দৃশ্য দেখতে পাবেন। মোবাইলের মাধ্যমেও ছবি তুলতে পারবেন। বেশি ভালো হয় যদি DSLR-এ Long Exposure ব্যবহার করেন।
শীঘ্রই নতুন এই ধূমকেতুকে নিয়ে আরো দারুণ কিছু ব্লগ আসছে। তাই BARC এর ব্লগ সেকশনের সাথেই থাকুন। আর যদি আপনিও আমাদের ওয়েবসাইটে নিয়মিত ব্লগ লিখতে চান তাহলে নীচের লিংকে যেয়ে এখনই ফর্মটি পূরণ করুন, নিয়মকানুন গুলো মেনে আপনার লিখা ব্লগটি আমাদের দেয়া ইমেইলে পাঠিয়ে দিন । আমরা যাচাই করে আপনার সাথে শীঘ্রই যোগাযোগ করবো।
ফর্ম লিংকঃ