দ্রুত রিসার্চ পেপার পড়ার ৫টি দারুণ হ্যাকস | পর্ব – ১

রিসার্চ পেপার বা গবেষণা পত্র! নামটি শুনলেই অনেকের চোখ কপালে উঠে যায়। হায়হায় কীভাবে পড়ে, অনেক জটিল বিষয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পেপার পড়ার আগ্রহ তো দূরে থাক, মনমানসিকতায় অনেক বেশি দূরত্ব দেখতে পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত কোনো বইপত্র থেকে শিখি না যে কীভাবে একটি গবেষণা পত্র পড়তে হয়। এই গবেষণা পত্র পড়ার আছে কিছু রীতি-নীতি, কিছু চমৎকার উপায় যার মাধ্যমে পুরো পেপারটি না বুঝলেও অন্তত সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে সেই পেপারের কাজ সম্পর্কে।

প্রতিদিন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অগণিত পেপার প্রকাশিত হয়। এমনকি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতিবছর সহস্রাধিক পেপার প্রকাশিত হয়। আর অধিকাংশ সময়ে আমরা কিছু ভুল করে থাকি এই পেপার পড়ার আগে এবং পরে। অনেকে আবার আমরা পেপার হাতে নিয়ে পড়ার আগেই ভয় পেয়ে যাই। যাইহোক চলে আসা যাক মোদ্দা কথায়। অনেকদিন যাবত আপনাদের সবার অনুরোধ এবং নিজ ইচ্ছায় পরিকল্পনা করছিলাম এই বিষয়ে লিখবার জন্যে কিন্তু ব্যস্ততার দরুণ তা আর হয়ে উঠছিলো না। তাই আজকে আমি ৫টি দারুণ হ্যাকস শেখাতে যাচ্ছি যা এখন থেকে আপনাদের রিসার্চ পেপার বা গবেষণা পত্র পড়ার এবং বুঝার ক্ষেত্রে আপনাদেরকে উদ্বুদ্ধ এবং সাহায্য করবে।

১। পেপারের বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকাঃ

আমরা অনেকেই যেই পেপারটি পড়ার জন্য উদ্যোগী হই তার বিষয় সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকায় আমরা আসলে দিন শেষে পেপারটি পরে কিছুই বুঝতে পারিনা। তাই আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের যেই বিষয়ের পেপারই হোক না কেন সেই বিষয় সম্পর্কে বেসিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যেমন ধরেন একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

আপনি হয়তো ধরেন বহির্বিশ্বের গ্রহগুলোকে বা যেগুলোকে বলা হয় এক্সোপ্লানেট (Exoplanet) কীভাবে আসলে সেগুলোকে ডিটেক্ট করা হয় সেটার উপর পেপার পড়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন। পেপার হাতেও নিলেন কিন্তু হাতে নিয়ে আগা-মাথা কিছুই বুঝলেন না কি লিখসে না লিখসে কারণ আপনি আসলেই জানেন না যে এক্সোপ্লানেট কী বা এই বিষয়ে কিছু প্রাথমিক ধারণা তো আপনার নেই। তাই না বুঝতে পারাটাই কিন্তু স্বাভাবিক তাইনা? এইজন্যই আমি মতামত দিবো আপনি কেই বিষয়ে পেপার পড়তে ইচ্ছুক সেই সম্পর্কে গুগল করে হোক কিংবা বইপত্র ঘেটে একটু হলেও যদি বেসিক টা ক্লিয়ার করে রাখতে পারেন তাহলে কিন্তু সেই পেপার পড়ার পরতি আগ্রহ আরো বেড়ে যাবে এবং পেপারটি পড়ে সেই বিষয়ের গবেষণাকে আপনি অনুভবও করতে পারবেন।

আর এই জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেসিক ক্লিয়ার করার লক্ষ্যেই কিন্তু Astronomy Pathshala বাংলাদেশে সর্বপ্রথম “AP Basic Astronomy Workshop” নামক তিন মাস অন্তর অন্তর হওয়া একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করে থাকে যেখানে আমরা কোলাবোরেশন করছি তিউনিশিয়ার সাথে আর সেখানে ক্লাস নিয়ে থাকেন বিশ্বের অনেক বড় মাপের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীগণ। অত্যন্ত সাফল্যের সাথে দুবার ইতিমধ্যে আয়োজন করে তৃতীয়বারের রেজিস্ট্রেশন চলছে যার বিস্তারিত আমাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এবং পেজে পাওয়া যাবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় আমরা অনেক শিক্ষার্থীবৃন্দদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেকগুলো টপিকের বেসিক ক্লিয়ার করতে সক্ষম হয়েছি। যাইহোক আসল কথায় ফিরে আসা যাক। আর ঠিক এভাবে যদি বেসিক নিয়ে কোনো একটি পেপার পড়া শুরু করেন তাহলেই কিন্তু আপনি পেপার পড়ার একটি অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।

২। পেপারের শুরুতে শিরোনাম, লেখকদের বিস্তারিত পড়ুনঃ

আমি ব্যক্তিগতভাবে যেই কাজটি করে থাকি সেগুলোই আসলে আপনাদেরকে জানানোর চেষ্টা করছি। আমি নিজেও যখন একটি পেপার পড়ি, মূল পেপার পড়া শুরু করার আগে আমি আসলে পেপারের টাইটেল এবং লেখকদের বিস্তারিত পড়ে থাকি। সেই লেখক কোথায়, কী নিয়ে গবেষণা করছেন সেগুলো দেখে নেয়া উচিত। আপনি যদি পেপারের টাইটেল পড়ে নাই বুঝেন যে পেপারটি আসলে কী নিয়ে তাহলে কিন্তু বিসমিল্লায় গলদ হওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হবে। কারণ পেপারের টাইটেল কিংবা শিরোনাম থেকে কিন্তু আমরা কিঞ্চিৎ ধারণা পেয়ে থাকি যে আসলে পেপারটি কী বিষয়ে লিখা সে ব্যাপারে। এতে করে পেপার, পেপারের লেখকদের সম্পর্কেও একটি ভালো জ্ঞান লাভ হয়ে গেলো যা পরবর্তীতে কাজে দিবে। কীভাবে কাজে দিবে সেটি আমি অন্যকোনো পর্বে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। পেপারের এলখকদের ব্যাপারে একটু ঘাটাঘাটি করার ফলে আপনার অনেক বিজ্ঞানীগণ কিংবা তাদের গবেষণা খাত যা নিয়ে আপনি অবগত ছিলেন না সেগুলোও কিন্তু আপনার জানা হয়ে যাবে।

৩। পেপারের সারাংশ (Abstract) পড়ুনঃ

প্রথমেই বলে রাখতে চাই আপনি কিন্তু কোনো পাঠ্যবই পড়ছেন ন কিংবা এটি কোনো গল্প-সাহিত্যের বই নয় যে আপনি তথাকথিত ধারায় পড়ে যাবেন আর বুঝে ফেলবেন। মনে রাখবেন আপনি কয়েকজন মানুষের কয়েক বছরের গবেষণার সাধনা, পরিশ্রমের আউটপুট কে পড়ছেন আর তাই শুরুতে একটু কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি কয়েকবার পড়েন তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি আসলে মহাবিশ্বের কোন বিষয়ের গবেষণার পত্রটি পড়ছেন। শুরুতেই আপনার সেই পেপারের ফলাফল, মেথোডোলোজি কিংবা কি কি বিষয় ইমপ্লিমেন্ট করেছে যেমন ক্যালকুলেশন, ডাটা এনালাইসিস ইত্যাদি পড়ার দরকার নেই। কারণ এতে আপনি ঘাবড়ে যেতে পারেন যা অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। শুরু করবেন পেপারের সারাংশ দিয়ে যাকে বলা হয় ‘’Abstract.’’ এই অংশটি সাধারণত একটি প্যারায় হয়ে থাকে আর এই অংশটি আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি একটি পেপার বুঝার ক্ষেত্রে কারণ এই অংশে আসলে লিখা থাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোন বিষয়ের কোন সমস্যা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে, কোনো নতুন কাজ করা হয়েছে কিনা, ফলাফল কি আসলো ইত্যাদি বিষয়ে ছোট্ট করে লিখা থাকে। এটি যদি বুঝতে কষ্ট হয় তাহলে ২-৩বার অন্তত পড়ুন। আমি নিজেও একই কাজ করে থাকি।

৪। এরপর ভূমিকা (Introduction) অংশটি পড়ুনঃ

সারাংশ পড়া হয়ে গেলে চলে যাবেন পেপারের ভূমিকা অংশে যেখানে সেই পেপারের লেখক বর্ণ্না করেছেন তাঁর গবেষণার বিষয়, এই বিষয়টির গুরুত্ব, কোন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন ইত্যাদি নানবিধ বিষয়ের ভূমিকা দিয়েছেন। যেমন কোনো একটি অনুষ্ঠান শুরু পূর্বে যেমন একজন সেই অনুষ্ঠান সম্পর্কে বর্ণনা দেন, সেই অনুষ্ঠানের সময়সূচি, অনুষ্ঠানটি আয়োজনের উদ্দেশ্য বলে থাকেন ঠিক তেমনি। এই অংশে লেখক আলোকপাত করেন তাঁর বিষয় নিয়ে। আমি এই ভূমিকা সম্পর্কে একটি ছোট্ট উদাহরণ দিতে চাই। যেমন ধরুণ আপনি এক্সোপ্লানেত নিয়ে পেপার পড়ছেন এবং তাঁর ভূমিকা অংশটি পরছেন। সেখানে আপনি আসলে কি কী বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন? আসলে সেখানে লেখক উল্লেখ করবেন এক্সোপ্লানেট সম্পর্কে, তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে, কী লাভ এই বিষয়ে গবেষণা করে, কীভাবে আমাদের সোলার সিস্টেমের বাহিরের গ্রহগুলোতেও বসতি স্থাপন করা যায় কিংবা প্রাণের আভাস পাওয়া যায় কিনা, এই বিষয়টির গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কিন্তু লেখক সেই পেপারের ভূমিকা অংশে আলোচনা করে থাকবেন এবং আপনিও সেটি পড়ে জানতে পারবেন। পেপারের বাকি অংশগুলো বুঝতে আপনাকে এই ভূমিকা অংশটি অনেক সাহায্য করবে। এটা অনেকটা কোনো একতা টপিকের ক্যালকুলেশনে যাওয়ার আগে থিওরী বুঝার মতো।

৫। এবার পড়ুন উপসংহার (Conclusion) অংশটিঃ

কোনো একটি পেপারের শিরোনাম, লেখকদের বিস্তারিত এরপর পেপারের সারাংশ এবং ভূমিকা পড়ার মাধ্যমে কিন্তু আপনি ওই পেপার সম্পর্কে কিছু জটিল বিষয় বাদে অনেকখানি জেনে গেছেন ইতিমধ্যে। এখন পড়বেন আপনি সেই পেপারের সর্বশেষ উপসঙ্গহার অংশটি পড়ে ফেলবেন। এখানে লেখকরা ব্যক্ত করার চেষ্টা করেন সাধারণত তারা কী কাজ করেছেন সেই বিষয়ে, যেই প্রব্লেমগুলো নিয়ে কাজ করেছেন সেগুলোকে আবারো একটু হাইলাইট করা, সেই লেখকের গবেষণার ফলাফলকে এককথায় প্রকাশ করা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়।

কাহিনী কি এখানেই শেষ? আপনি কি ভাবছেন যে আপনি পুরো পেপার পড়ে ফেলেছেন? একদম না। আপনি এখনো পুরো পেপারটি পড়েন নি কারণ এখনো অনেক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় শুধু সেই বিষয়গুলো স্কিপ করে খুব দ্রুত কোনো একটি পেপার সম্পর্কে এবনফ গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা লাভ করলেন। আমি আপনাদেরকে যেই পদ্ধতিটি শিখিয়ে দিলাম সেটিকে কিন্তু আসলে ‘’Birds Eye Technique’’ বলে যার অর্থ আপনি পুরো পেপারটি না পড়ে বুলেট পয়েন্ট গুলো পড়ে ওই পেপার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করলেন অত্যন্ত দ্রুত এবং অল্প সময়ে ঠিক যেভাবে পাখি উড়ার সময়ে উপর থেকে একনজরে পুরো জায়গাটি পর্যবেক্ষণ করে ঠিক তেমনি। তাহলে বাকি বিষয়গুলো? ভয় পাওয়ার কিছু নেই কারণ এটি ছিলো প্রথম পর্ব কেবল। বাকি বিষয়গুলো নিয়ে শীঘ্রই হাজির হবো এর দ্বিতীয় পর্বে।

এই নোটটি আপনাদের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন তারাও এই নোটটি পড়ে কীভাবে দ্রুত রিসার্চ পেপার পড়তে হয় তা নিজে শিখে অন্যকেও শেখাতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!