১৯৬২ সালের ১৭ মার্চ কল্পনা চাওলা ভারতের হারিয়ানা রাজ্যের কার্নাল গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।বাবা মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। গ্রীষ্মকালে যখন তারা রাতে ঘরের ছাদে শুয়ে থাকত, তখন কল্পনা রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতেন।
চাওলা ভারতের কারনালে জন্মগ্রহণ করেন এবং শৈশব থেকেই ফ্লাইটের প্রতি মুগ্ধ ছিলেন। চাওলার কাছে বিমান, গ্লাইডার এবং সী প্লেন সহ অসংখ্য পাইলট লাইসেন্স ছিল।
স্নাতক : কর্নালের ঠাকুর বাল নিকেতন সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল থেকে স্কুলিং শেষ করে কল্পনা দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করলেন ১৯৭৮ সালে। তার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। কিন্তু এই স্বপ্নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন কল্পনার বাবা। তার বাবার ধারনা ছিল মেয়েদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার চেয়ে শিক্ষকতা অথবা ডাক্তারি পড়া উত্তম। তবে কল্পনা ছিলেন তার সিদ্ধান্তে দৃঢ়ভাবে অটল। ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যতীত অন্যকিছু পড়তে ছিলেন নারাজ।
পরবর্তীতে মায়ের সম্মতিতে স্বপ্নপূরনের অনুমতি পাওয়া গেলে তিনি ভর্তি হন চন্ডীগড়ের পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ১৯৮২ সালে সেখান থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন তৃতীয় স্থান অর্জন করে। তার কলেজ থেকে তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট।
স্নাতকোত্তর: অত্যন্ত ভালো ফলাফল আর কলেজের অ্যারো এবং অ্যাস্ট্রো সোসাইটির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকায় খুব সহজেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাসে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স করার সুযোগ পান। এক সাক্ষাৎকারে কল্পনা তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে করতে বলেন,
আমরা বাবাকে বলতাম আমাদের বিমানে চড়াতে তখন বাবা আমাদের পুষ্পক আর খেলনা বিমানে চড়াতে নিয়ে যেতেন। আমার মনে হয়, সেটিই আমাকে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাথে জুড়ে দেয়।
১৯৮৪ সালে তিনি টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ১৯৮৬ সালে ইউনিভার্সিটি অভ কলোরাডো বোল্ডার থেকে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর তার দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেন।
পিএইচডি: ১৯৮৮ সালে শেষ করেন তার ডক্টরাল স্টাডিজ, যার মাধ্যমে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী পান।
কল্পনা ব্যক্তিগত জীবনে ফরাসী নাগরিক জিন পিয়েরে হ্যারিসন এর সাথে ১৯৮৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। ১৯৯১ সালে কল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান।
১৯৮৮ সালে তার পিএইচডি সম্পন্ন করার পর, চাওলা NASA-এর Ames গবেষণা কেন্দ্রে যোগদান করেন, যেখানে তিনি বিমানের তরল গতিবিদ্যায় বিশেষায়িত হন। পরে তিনি বেসরকারি খাতে অ্যারোডাইনামিকস গবেষণা চালিয়ে যান। 1991 সালে চাওলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হন। NASA 1994 সালের শেষের দিকে কল্পনা একজন মহাকাশচারী হিসেবে বেছে নেয় এবং তিনি 1995 সালে মহাকাশচারী প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
স্পেসফ্লাইটের প্রস্তুতির পাশাপাশি, নভোচারীদের স্থল-ভিত্তিক প্রযুক্তিগত প্রকল্পগুলির সাথেও কাজ করা হয়। রোবোটিক সিচুয়েশনাল অ্যাওয়ারনেস ডিসপ্লের উন্নয়নে কাজ করেছিলেন, যা নভোচারীদের রোবোটিক অস্ত্র পরিচালনা করতে সাহায্য করার একটি টুল। তিনি স্পেস শাটল নিয়ন্ত্রণ সফ্টওয়্যারও পরীক্ষা করেছিলেন।
কল্পনা চাওলা দুটি স্পেস শাটল মিশনে 30 দিনের বেশি মহাকাশে কাটিয়েছিলেন। তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েই খুব অল্প দিনের মধ্যেই তিনি মহাকাশ অভিযানের সুযোগ পেয়ে যান।
১৯৯৬ সালে ১ম বার তিনি মহাকাশ অভিযানে নভোচারী হওয়ার সুযোগ পান। সেখান থেকেই শুরু হয় কল্পনার প্রথম মহাকাশ অভিযান। ১৯৯৭ সালের ১৯ শে নভেম্বর ০৭ জন নভোচারীসহ মহাকাশ কলম্বিয়া যানে চড়ে আমেরিকার ক্যানাডিয়ান স্পেস সেন্টার থেকে মহাকাশ অভিযানের জন্য রওনা দেয়। NASA এই মহাকাশ অভিযানের নাম দেয় STS কলম্বিয়া মহাকাশ যানটির এটা ছিল ২৪ তম মহাকাশ যাত্রা। মহাকাশে গিয়ে কল্পনা ও তার সহগামী নভোচারীরা পৃথিবীকে ২৫২ বার প্রদিক্ষন করেন। সবমিলিয়ে তারা মহাকাশ অভিযানে গিয়ে ১ কোটি ৬২ লক্ষ মাইল পথ অতিক্রম করেন। NASA র থেকে কল্পনা ও তাঁর টিমের প্রথম কাজ ছিল মাইক্রোগ্রাভিটি লোডের ব্যবহার করে মহাকাশ সম্পর্কে অজানা সব বিস্তারিত কথা নাসার কন্ট্রোল রুমে প্রেরণ করা। STS-87-এর সময়, তিনি স্পার্টান স্যাটেলাইট স্থাপনের জন্য দায়ী ছিলেন যা ত্রটিপূর্ণ ছিল, স্যাটেলাইটটি ক্যাপচার করার জন্য উইনস্টন স্কট এবং তাকাও ডোই দ্বারা একটি স্পেসওয়াকের প্রয়োজন হয়। একটি পাঁচ মাসের NASA তদন্ত সফ্টওয়্যার ইন্টারফেস এবং ফ্লাইট ক্রু এবং গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সংজ্ঞায়িত পদ্ধতিতে ত্রটি সনাক্ত করে চাওলাকে অব্যাহতি দিয়েছিল। STS-87 পোস্ট-ফ্লাইট কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর, চাওলাকে মহাকাশচারী অফিসে টেকনিক্যাল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল মহাকাশ স্টেশনে কাজ করার জন্য।
২০০০ সালে এসটিএস-১০৭ মিশনে আবার তাকে মিশন স্পেশালিস্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয়। স্পেস শাটল কলম্বিয়ার চূড়ান্ত অভিযান। প্রাথমিকভাবে সেই মিশন জানুয়ারি ২০০১ সালে যাত্রা শুরুর কথা থাকলেও তা বিলম্বিত হয়ে ২০০৩ সালে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে লঞ্চ করা হয়।স্পেস সাটলটি ১৫ দিন ২২ ঘণ্টা মহাকাশে অবস্থান করে। শাটলটি উড্ডয়নের ৮১.৭ সেকেন্ড পরেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক টুকরো ফোম শাটলটির বাম পাশের অরবিটারের ক্ষতিসাধন করে। তা সত্ত্বেও মিশনটি সফলভাবে চলতে থাকে।
শুনতে কঠিন হলেও এটাই বাস্তব, একবার স্পেস শিপ আকাশে উড়ে যাওয়ার পর দুঃঘটনার আশংকা থাকলে কিংবা দুঃঘটনার স্বীকার হলে কারো হাতে কিছু করার থাকেনা।
২০০৩ সালের ০১ ফেব্রুয়ারী ভারতীয় সময় সন্ধে ০৭:৪৬ নাগাদ কলম্বিয়া ক্যানাডীয় SLF রানওয়ে ৩৩ এ ল্যান্ড করার কথা ছিল। ১৫ দিন ২২ ঘন্টা ৩২ সেকেন্ড মহাশুন্যে কাটানোর পর এটমোস্ফিয়ারের পর্দা ভেদ করে পৃথিবীর কক্ষপথে ঢুকে নিরাপদ ভাবে ল্যান্ড করার সময় ঘনিয়ে আসছিল।
আনুমানিক সন্ধে ০৭:১০ মিনিট নাগাদ কলম্বিয়া পৃথিবীর কক্ষপথে এটমোস্ফিয়ারে প্রবেশ করে, কিন্তু এটমোস্ফিয়ারের গরম হাওয়ার প্রেসার কলম্বিয়ার ডানায় থাকা ছিদ্র দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকতে শুরু করে। অসহনীয় গরম হাওয়ায় নভোচারীরা যানের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর ধীরে ধীরে কলম্বিয়ার ইঞ্জিন কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে কিন্তু খুব বেশিক্ষন টিকে থাকতে পারেনা কলম্বিয়া, আনুমানিক সন্ধে ০৭:৩০ নাগাদ ০৫-০৭ মিনিটের মধ্যে কলম্বিয়া মহাকাশযানটি আগুনের গোলার মত বিস্ফোরিত হয়ে, উল্কাপিণ্ডের ন্যায় আমেরিকার টেক্সাস শহরের উপর ভেঙে পড়ে। নাসার STS-১০৭ মিশন সফল না হলেও বিশ্ববাসী কল্পনা ও তার সাধীদের মাথায় গৌরবের মুকুট পড়িয়েছে। যদিও কল্পনা চাওলা ও তার সাথীদের STS-১০৭ মিশনে দুঃঘটনার স্বীকার হয়ে অকস্মাৎ মৃত্যু সত্যি বেদনাদায়ক, তবে তাদের এই বলিদান ব্যর্থ নয়।